আপনার সন্তান জঙ্গি! কিভাবে বুঝবেন? (এ.আই. তরিকুল)

এ জগত সংসারে ব্যস্ততার শেষ নেই। শেষ নেই কর্মযজ্ঞের কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে আমাদের নিরাপদ জীবন যাপন অপরিহার্য। নিরাপত্তা আমাদের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে যেমন সামাজিক অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে এবং অন্যদিকে দেশ ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের জনগণ, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিরাপত্তার প্রয়োজন। নিরাপত্তার জন্য বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র বিশাল অঙ্কের আর্থিক খরচ বহন করে। গঠন করা হয় সামরিক বেসামরিক নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু এতকিছুর পরও নির্মমতা, গুম, খুন, ধর্ষন, হত্যা, অবিচারের কমতি নেই। বিলাসবহুল জীবন যাপন, অবৈধ উপায়ে অর্থ বিত্তের মালিকানা লাভের আশায় ত্রাসের রাজত্ব, আধিপত্য বিস্তার, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জন্ম হয়।
‌জঙ্গিবাদ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝি: সম্প্রতি ইসলাম ধর্মের নামে কোনো স্বসস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অন্যায় ও অতর্কিত ভাবে বেসামরিক কোনো বাহিনী বা সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোকে বুঝে থাকি।

‌ইসলাম কী বলে:

‌ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্হান নেই। ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আদেশ রয়েছে।অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা বলা আছে। ত্যাগ শিকার করার কথা বলা আছে। অন্যায় ভাবে নিরপরাধ মানুষ নির্বিচারে হত্যা করা ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ (মহা পাপ) । “আল-জিহাদ ফিসাবিলিল্লাহ” তথা আল্লাহর রাস্তায় ত্যাগ শিকার করা। পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। লোভ-লালসা, হিংসা বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা। ইসলাম ধর্মে আল্লাহর রাস্তায় তাওহীদ তথা একত্ববাদ তথা সত্যের জন্য অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এবং নফস্ তথা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কারীদের মুজাহিদ আখ্যায়িত করা হয়েছে। এবং সে যুদ্ধ কে জিহাদ বলা হয়। সে অনুযায়ী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালী জাতির জিহাদ বলা যায়। যেহেতু ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল নিরপরাধ বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধ।
‌অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে এবং সেটি ছিল বীর বাঙালীর অধিকার আদায়ের যুদ্ধ।
‌জিহাদ আর জঙ্গিবাদের আকাশ পাতাল পার্থক্য।

‌’জঙ্গ’ উর্দূ শব্দ যার বাংলা অর্থ ‘যুদ্ধ’। জঙ্গি অর্থাৎ যুদ্ধা। বর্তমানে শব্দটি বাংলায় সন্ত্রাস শব্দের অর্থে প্রচলিত রয়েছে।

‌ তথাকথিত জঙ্গি অর্থাৎ স্বসস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা বিচ্ছন্নতাবাদী দের সঙ্গে আমাদের দেশের ছাত্র ও শিক্ষিত যুব সমাজের জড়িয়ে পড়ার ঘটনার জন্য সর্বমহলই আতঙ্কিত এবং শঙ্কিত।
‌বাবা-মায়েরা অনেক সময় ধারণাই করতে পারেন না যে তাঁদের শান্ত-সুবোধ সন্তান জঙ্গিবাদ আর চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ, ক্যারিয়ার আর বাহ্যিকভাবে তার আচরণ দেখে বাবা-মায়েরা তৃপ্ত থাকলেও কখনো কখনো সন্তানের বহিরাবরণ ভেদ করে তার অন্তরের কাছাকাছি পৌঁছানো দরকার। শিশুর অন্তঃকরণ জানতে হলে তার ধারণার জগৎটি কীভাবে গড়ে ওঠে, তা বাবা-মাকে খানিকটা বুঝতে হবে।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়:
সুইস মনোবিজ্ঞানী জ্যঁ পিয়াজে শিশুদের ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশের বিখ্যাত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ৭ থেকে ১১ বছর বয়সের একটি শিশুর মধ্যে কংক্রিট অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়, যখন আশপাশ সম্পর্কে সে অনেক যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে। কোনো বস্তুর ধারণায় সে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয়। আর ১১ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত তার মধ্যে ফরমাল অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়, যখন তার ধারণার জগৎটি অনেক বিস্তৃত হতে থাকে, বিমূর্ত হতে থাকে এবং কার্যকারণ বিবেচনা করে সে তার ধারণা প্রস্তুত করে। এই ফরমাল অপারেশনাল পর্যায়টি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এই সময়টিতেই একজন তরুণের মধ্যে যেকোনো বিশ্বাস বা আদর্শ দানা বাঁধতে থাকে। এই বিশ্বাস বা আদর্শ হতে পারে পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ার-নির্ভর অথবা পার্থিব ভোগবাদে পরিপূর্ণ কিংবা পুরোপুরি পরার্থবাদী। আবার কখনো-বা হতে পারে মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসনির্ভর কূপমণ্ডূক জঙ্গিধারণায় পরিপূর্ণ। তাই এই ১১-১২ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত সন্তানকে বুঝতে পারাটা খুব জরুরি।

মার্কিন গবেষক লরেন্সকোহলবার্গ পিয়াজের ধারণার জগৎ বা জ্ঞনীয় বিকাশের পর্যায়গুলোর সঙ্গে নৈতিক বিকাশের যোগসূত্রও তুলে ধরেন। মানুষের নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়—‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর—যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যেকোনো পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। একজন তরুণের মনোস্তত্ত্ব এখানেই জঙ্গিবাদে মোড় নেয়। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে তার মধ্যে জন্ম নেয় উগ্রবাদ আর ভ্রান্ত বিশ্বাস। কিন্তু ওই যে তার ধারণার জগৎটিই পাল্টে গেছে, তাই সেই উগ্রবাদ আর নিষ্ঠুরতাকে সে ন্যায্য বলে মনে করে। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা আর সন্ত্রাস তার কাছে নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার এক ‘উপযুক্ত’ পদক্ষেপমাত্র।

বয়ঃসন্ধিকাল থেকে পরিণত বয়স, যেমন ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত একজন তরুণের মনোজগতের এই পরিবর্তনটি আশপাশের সবাইকে বুঝতে হবে। এই বয়সে তার মনোজগতের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী—খেয়াল রাখতে হবে যে, এই পরিবর্তন যেন ইতিবাচক দিকে হয়—ধর্মান্ধতা বা জঙ্গিবাদের দিকে না হয়।

এ জন্য অভিভাবক, বিশেষ করে বাবা-মায়েদের যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে, তা হলো—

আচরণের পরিবর্তন:

হঠাৎকরে আপনার সন্তানের আচরণের পরিবর্তন ঘটছে কি না, নজর রাখুন। যেমন সে হঠাৎ করে আগের বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মিশছে না, খানিকটা একা হয়ে গেছে—নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে, কথাবার্তা কম বলছে, স্বভাবটি চাপা হয়ে গেছে, পুরোনো বইপত্র, গানের সরঞ্জাম ফেলে দিয়ে নতুন নতুন বইপত্র পড়া শুরু করেছে ইত্যাদি।

আচার-আচরণের পরিবর্তন:

ধর্ম পা​লনের যে স্বাভাবিক ও প্রচলিত রীতি–নীতি রয়েছে, হঠাৎ করে আপনার সন্তান সেই রীতি–নীতি থেকে ভিন্ন রকম আচরণ করছে কি না খেয়াল করুন। দেখুন হঠাৎ​ করে আগের চেয়ে তার আচরণে বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না।

বাড়ির বাইরে রাত কাটানো:

বেড়াতেযাওয়ার নামে বা বন্ধুর বাসায় থাকার নামে প্রায়ই বাসার বাইরে রাত কাটাচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন, সত্যিই কোথায় রাত কাটায়, কী করে জানার চেষ্টা করুন।

ঘরে কী করছে:

অনেকসময় ঘরে দরজা বন্ধ করে একাকী বা নির্ধারিত বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালে তাদের নিরুৎসাহিত করুন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী করছে:

আপনারসন্তান স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, তার খোঁজখবর করুন।

কী ধরনের বই পড়ছে:

পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সে কী ধরনের বই পড়ছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিন। তার ঘরে থাকা বইগুলো প্রয়োজনে আপনিও পড়ুন এবং সেখানে কোনো উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদের তথ্যসমৃদ্ধ বই আছে কি না, যাচাই করুন। সে কোন ধরনের সিনেমা দেখছে খেয়াল রাখুন, প্রয়োজনে তার সঙ্গে বসে সেই সিনেমা আপনিও দেখুন।

ইন্টারনেটে কী করে:

সে ইন্টারনেটে কী করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বন্ধু কারা, সে কোন কোন গ্রুপ ফলো করে, তার মন্তব্যগুলো কী রকম, তা জানার চেষ্টা করুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনিও তার বন্ধু থাকুন।

কথাবার্তা খেয়াল করুন:

তার প্রতিটি কথাবার্তা এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া বিষয়াদি নিয়ে তার মন্তব্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিন। তার কোনো কথা বা মন্তব্যে আপনার যদি মনে হয় সেগুলো খুব বেশি র্যাডিকাল বা জঙ্গি ভাবাদর্শের প্রতি নমনীয়, তবে আপনার সন্তানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখুন।

বিষণ্নতা আছে কি না দেখুন:

কখনো বিষণ্নতা, হতাশা বা তীব্র অবসাদ তরুণদের এই ধরনের জঙ্গি হওয়ার অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে। ফলে বিষণ্নতা বা হতাশার কোনো লক্ষণ আপনার সন্তানের মধ্যে আছে কি না, খেয়াল রাখুন।

মনে রাখবেন, আপনার সন্তান সে যত মেধাবীই হোক, যতই তথাকথিত আধুনিকমনস্ক হোক না কেন, সে ছেলে হোক বা মেয়ে, যে মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ুক না কেন—জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। জঙ্গিবাদ এমনই এক দানব, যা গ্রাস করতে পারে আমাদের আগামী প্রজন্মকে—দুর্বল একটি রন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করতে পারে আপনার প্রিয়জনের অন্তঃকরণে। প্রতিরোধের সময় কিন্তু এখনই।

প্রতিরোধ যেভাবে:

ইন্টারনেটের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করুন

১৮ বছর বয়সের আগে একান্তে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে সন্তানকে নিবৃত্ত করুন। বাড়িতে ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে রাখুন।

উৎসাহিত করবেন না:

সন্তানের মধ্যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক আচরণ দেখলে সেগুলোকে কোনোভাবেই উৎসাহিত করবেন না। তার কোনো জঙ্গিভাবাপন্ন মন্তব্যকে হেসে উড়িয়ে দেবেন না।

দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি সন্তানদের উৎসাহিত করতে হবে। বাঙালী জাতির গৌরবের কথা বলতে হবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবসময়ই সতর্ক এবং সচেতন থাকুন।

নিজে সুস্হ থাকুন এবং অন্যকে সুস্হ রাখুন। আপনার মঙ্গল কামনা করছি।

 

Be the first to comment

Leave a Reply